সিলেট জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সাদা পাথর একটি গুরুত্বপূর্ণ দর্শনীয় স্থান। সিলেটের সাদা পাথর ভ্রমণ পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ। সিলেট শহরের আম্বরখানা বা মাজারগেট থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার পথ যেতে হয়। পথটি প্রসস্থ এবং প্রায় ৩৫ কিলোমিটার সড়ক ঢালাই করা। এর সাথে সিলেটের অন্যান্য দর্শনীয় স্থানও রয়েছে।
সিলেটে ভ্রমণে আবাসিক সুবিধাসমূহ:
বেশির ভাগ পর্যটকই সিলেটের বাহির থেকে আসেন। সিলেটের বাহির থেকে বা দূর থেকে আসা পর্যটকগণের সিলেট মহানগরে থাকা বা রাত কাটানোর জন্য অনেক ধরণের আবাসিক হোটেল সুবিধা আছে। যেমন:
১. গ্রান্ড সিলেট হোটেল এন্ড রিসোর্ট:
উচ্চ বিলাসীদের জন্য আবাসিক হোটেল হিসেবে গ্রান্ড সিলেট হোটেল এন্ড রিসোর্ট অন্যতম। পাঁচ তারকা হোটেলের যে সকল সুবিধা থাকে তার সবই এখানে আছে। নিরিবিলি পরিবেশ। সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের পাশে এটির অবস্থান। বিদেশি পর্যটক এবং বিদেশি ফুটবল/ ক্রিকেট দলের খেলোয়াররা সাধারনত এই হোটেলেই ওঠেন। মোবাইল: ০১৩২১-২০১৬০০।
২. হোটেল নুরজাহান গ্রান্ড:
এটি একটি থ্রি-স্টার হোটেল। রাজকীয়ভাবে থাকতে চাইলে হোটেল নুরজাহান পছন্দ করতে পারেন। মোবাইল:০১৯৩০-১১১৬৬৬, ওয়েবসাইট: https://www.noorjahangrand.com/ .
৩. রোজ-ভিউ:
রোজ ভিউ সিলেটের প্রথম আধুনিক হোটেল। আবাসিক হোটেল “রোজ ভিউ” থ্রি স্টার মানের। মূল শহরের প্রবেশ মুখে (উপশহর) এটি অবস্থিত। এই হোটেলের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় খাওয়ার উন্নত পরিবেশের পাশাপাশি সুইমিং পুল সুবিধা আছে। বিপিএল এবং বিভিন্ন টুর্নামেন্ট এর সময় বিভিন্ন দলে খেলোয়ার ও ম্যানেজমেন্ট এখানে থাকেন।
৪. অন্যান্য:
রোজ ভিউ এর পাশেই রয়েছে “গ্রান্ড সুরমা” হোটেল (মোবাইল নম্বর: ০১৭১২-৫২৪৩০১)। অল্প ভাড়ায় উন্নত পরিবেশ। এছাড়াও এসি, গিজার, ফ্রিজ এবং রেস্টুরেন্ট সুবিধা আছে এখানে। জিন্দাবাজারের গ্রান্ড প্যালেস একই মানের। কদমতলী বাস টার্মিনালে অনেক আবাসিক হোটেল আছে। হোটেল তৌফিক অন্যতম। হযরত শাহজালাল মাজার গেট এবং তৎসংলগ্ন অসংখ্যা আবাসিক হোটেল আছে। অপেক্ষাকৃত কম টাকায় এখানে থাকার সুবিধা আছে।
সাদা পাথর ভ্রমণের উপযুক্ত সময় বা কখন যাবেন
সাদা পাথর যাওয়ার উপযুক্ত সময় হলো বর্ষাকাল এবং শরৎকাল। ইংরেজি মাস হিসেবে জুন হতে সেপ্টেম্বর। আরো ছোট করে বললে আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাস। এসময় পানি সবচেয়ে বেশি স্বচ্ছ থাকে। পানিতে সাতার কাটতে পারবেন। যারা সাতার পারেন না তাদের জন্য টিউবের ব্যবস্থা আছে।
প্রকৃতির পানি কতটা স্বচ্ছ হয় তা সেখানে দেখা যায়। তবে অন্যান্য সময়ও ভ্রমণ করতে পারবেন। তখন হাটু পরিমাণ পানি তো অবশ্যই পাবেন। শুক্রবার ও শনিবার এবং সরকারি ছুটিতে খুব ভিড় থাকে। বিশেষ করে দূর্গাপুজোর সময়।
সিলেট শহর হতে সাদা পাথর ভ্রমণ-এ যাওয়ার উপায়
আগের রাতেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে কিভাবে সাদা পাথর যাবেন। নিম্নোক্ত উপায়ে যেতে পারেন:
- প্রাইভেট গাড়ী;
- ভাড়া গাড়ী;
- মোটর সাইকেল;
- থ্রি-হুইলার সিএনজি; এবং
- বাস (গণপরিবহন বা রিজার্ভ)
বাসে ভ্রমণ:
ব্যয়ের পরিমাণ কমাতে চাইলে বাস পছন্দের তালিকায় রাখতে হবে। সিলেটের আম্বরখানা/ মাজারগেট হতে সাদা পাথর ভ্রমণ অধিকতর আনন্দদায়ক করতে হলে বাস ভ্রমণই উত্তম। আম্বরখানা বা মাজারগেট হতে দুই ধরনের বাস পাওয়া যায়।
১. সাদা পাথর ভ্রমণ; এবং
২. বি.আর.টি.সি.।
সাদা পাথর ভ্রমণ নামের বাসটির বেশিরভাগ অংশই সাদা রঙের। এটি একটি সাধারণ এক ছাদের বাস। তবে, বিআরটিসি’র বাসগুলো সবই দুই তলা বিশিষ্ট। প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত বাস পাওয়া যায়। প্রতি ৩০ মিনিট পরপর বিআরটিসি’র দুই তলা বাস আম্বরখানা, সিলেট থেকে সাদা পাথরের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। এছাড়া, সকাল ৯.৩০ থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সাদা পাথর থেকে আম্বরখানার উদ্দেশ্যে বাসগুলো চলে। সিলেট ও সাদা পাথর এই বাস চলাচল করে।
বিআরটিসি বাসে সাদা পাথর যাওয়া দৃশ্যাবলী:
ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য বিআরটিসি বাস একটি আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা। সাদা পাথরে যাওয়ার বাসের জন্য ৩০ মিনিটের বেশি অপেক্ষা করতে হয় না। বিআরটিসির ভাড়া ৭৫ টাকা প্রতি যাত্রী। বাসের দোতলায় ভ্রমণ করলে আনন্দ দ্বিগুণ হবে। সবুজ চা-বাগান এবং গাছপালা আপনার ভ্রমণকে বিশেষ করবে। দোতলায় বসে নিচের দৃশ্যগুলো মনকে উৎফুল্ল করে তুলবে।
বাসের দোতলায় ভ্রমণ করলে যা উপবোগ করতে পারবেন:
- বাস ছেড়ে যাওয়ার ৩-৪ কি.মি পরেই রাস্তার দুই পাশের ন্যাশনাল টি-এস্টেট টা-বাগান(লাক্কাতুরা);
- তার কিছুটা পরেই রাস্তার বাম পাশে সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম। তবে বাস থেকে দেখা যাবেনা।
- কিছুটা আকাঁবাকাঁ-উচুনিচু পথ পাড়ি দিতেই বাংলাদেশের প্রথম চা-বাগান মালনিছড়া। রাস্তার দু-পাশেই সবুজ সমারোহের চা-বাগান আপনাকে মুগ্ধ করবেই।
- মানলিছড়া পার হলেই রাস্তার ডানদিকে সিলেট ক্যাডেট কলেজ দেখতে পাবেন।
- ক্যাডেট কলেজ পেরোলেই বাস ডানদিকে মোড় নিবে। মোড় নেবার ৩-৪ কি.মি. পরেই সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। ৪-৫ কি.মি রাস্তা বিমানবন্দরের গা-ঘেষে রয়েছে। সময়ক্ষণ মিলে গেলে বিমান ওঠানামা দেখতে পাবেন।
আরও যা উপভোগ করতে পারবেন
- আকাঁবাকাঁ-উচুনিচু ও হাওড় পথ পাড়ি দেবার পর ডানদিকে একটি হাইটেক পার্ক দেখা যাবে।
- রাস্তার দু-ধারে পাথর ভাঙ্গা মেশিন ও পাথর ভাঙ্গার পদ্ধতি/ ধরন দেখা যাবে।
- হাইটেক পার্ক অতিক্রম করার পর সামনের দিকে তাকালে পাহাড় দেখতে পাবেন। এ দৃশ্যগুলো দেখতে দেখতে বাস তার গন্তব্যস্থলে থামবে। এবং বাসের সুপারভাইজার বলবে নামেন নামেন সাদা পাথর আইসা পরছি।
- বাস থেকে নেমে প্রায় ১০০ মিটার হাটলেই নৌকাঘাট।
সাদা পাথরে নৌকা ভ্রমণ:
আপনি যে বাহনই ভ্রমণ করেন না কেন সাদা পাথর পৌছার পর মূল স্পর্টে যাওয়ার জন্য নৌকা ভ্রমণ করতে হবে। প্রতি নৌকা ৮০০ (আটশত) টাকা। যাওয়া-আসা মিলে ০২-০৩ ঘন্টা সময় দিয়ে থাকে। তবে নৌকার মাঝির সাথে আলাপের মাধ্যমে সময় বৃদ্ধি করা যায়। একটি নৌকায় ০১ থেকে সর্বোচ্চ ০৮ জন ভ্রমণ করা যায়।
আপনার দল ০৮ জনের কম সদস্যের হলে চিন্তার কারণ নেই। আপনার মন চাইলে অন্যান্য পর্যটকদের সাথে নিতে পারেন। এতে কোনো সমস্যা হবেনা। তবে ৫-৬ জন হলে অন্যদের না নেওয়াই ভালো। এতে সময় ও অন্যান্য পারিপার্শিক বিষয়ে স্বাধীনতা পাবেন। নৌকা ঘাটিতে একটি টিকিট কাউন্টার আছে। এখান থেকেই টিকিট সংগ্রহ করতে হবে। যে নৌকায় যাবেন সেই নৌকায় ফিরে আসবেন। এজন্য অবশ্যই মাঝির মোবাইল নিবেন।
মূল স্পট:
নৌকাযোগে মূল স্পটে পৌঁছার পর ৩০০-৪০০ মিটার হাটতে হবে। আপনি বেশি সৌখিন হলে ঘোড়ায় যেতে পারবেন। ছোট বাচ্চাদের বেশি আবদার না থাকলে হেটে হেটে যাওয়ায় ভালো। আর এই ৩০০-৪০০ মিটার যাওয়ার পরই ছোট-বড় স্তর, স্থুপ বা জমিন দেখতে পাবেন। এখানে শুধু পাথর আর পাথর দেখতে পাবেন। সাদার সাথে অন্য রংয়েরও পাথর আছে। এই পাথরের উপর দিয়ে বয়ে চলছে স্বচ্ছ পানির স্রোত। পাহাড় থেকে নেমে আসা এই পানি খুবই স্বচ্ছ। এখানের পাথর আর পানির একত্রিত সৌন্দর্য আপনাকে ভিজতে আগ্রহ জাগাবে।
মূল স্পটে যা যা উপভোগ করতে পারবেন
সাদা পাথর মূল স্পটে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত আছে। এখান থেকে ভারতের বিশাল বিশাল পাহাড় দেখতে পাবেন। সাথে বড় বড় পাথর। পাহাড়ের উপর মেঘমালা। মনে হবে এই বুঝি বৃষ্টি নামবে। মাঝে মাঝে পাথরের কিট শব্দ শুনতে পাবেন । এতে ভয় পাবেরন না। এগালো ভারতীয়দের পাথর কাটার শব্দ।
সীমান্তের কাছে বাংলাদেশী যায়গায় মসজিদ ও গণসৌচাগারের সুবিধা রয়েছে। কাপড় পরিবর্তনের ব্যবস্থা আছে। তাছাড়াও কাপড় পরিবর্তনের জন্য ভ্রাম্যমান চেঞ্জ রুম পাবেন। বেশি পানি ও পানির স্রোতে গা ভাসানোর জন্য টিউব পাবেন। বিশ্রামের জন্য চৌকি-বেড আছে। এগুলো ব্যবহারের আগে ভাড়া দরদাম করে নিবেন।
সাদা পাথর ভ্রমণ করলে কোথায়, কী খাবেন
মূল স্পটে ডাব, আইসক্রিম ও ছোট বাচ্চাদের শুকনো খাবার পাবেন। চলতি মানেরও ভারি খাবার পাবেন না। খাবারের জন্য ফিরে আসতে হবে নৌকা ঘাটিতে। সেখানে চলতি মানের কিছু খাবার হোটেল, রেস্তরা আছে। খাওয়ার আগে তরকারি দেখে নিবেন। পাকস্থলির সমস্যা থাকলে বা খুব বেশি ক্ষুধা না থাকলে এখানে না খাওয়াই উত্তম। বিকেল বা সন্ধ্যা যাই হোক সিলেট শহরে এসে খেতে পারেন। শহরের বিখ্যাত পাঁচভাই, পানসি, ভোজনবাড়ীর খাবার বেশ সুস্বাদু ও রুচিশীল। খাবারের দামও বেশি নয়।
সাথে যা যা নিবেন
সিলেটের সাদা পাথর ভ্রমণ করতে গেলে কিছু জিনিসপত্র আপনার সংগ্রহে অবশ্যই থাকতে হবে। যেমন:
- খাবার পানি;
- শুকনো খাবার। বিশেষ করে ছোট বাচ্চা থাকলে;
- ওয়াটার প্রুভ সেন্ডেল বা জুতা;
- গোসলের ইচ্ছা থাকলে অতিরিক্ত একসেট কাপড়;
- ভেজা কাপড় রাখার জন্য পলিথিন বা পৃথক কোন ব্যাগ।
সাদা পাথর ভ্রমণে সতর্কতাসমূহ
- লাল পতাকা চিহ্নিত বা সীমানা অতিক্রম করবেন না।
- চর্মরোগ থাকলে এই পানিতে না ভেজায় ভালো।
- সাবধানে ছোট বাচ্চাদের পানিতে নামাবেন।
- স্রোতের অনুকূলে একটানা গা ভাসাবেন না। শরীরের কোন অংশ বিশেষ করে মাথা পাথরে লাগলে বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।
- ছবি উঠানোর জন্য মোবাইল পানিতে না নেয়াই ভালো। নিলেও সাবধানে ব্যবহার করবেন।
- দরদাম না করে চৌকিতে বসবেন না। টিউব ব্যবহার করবেন না।
- লকার ব্যবহার করলে লকারের চাবি নিজের কাছে রাখবেন।
- এখান থেকে ছোট-বড় যেকোন পাথর সংগ্রহ আইনত দন্ডনীয় অপরাধ।
- সন্ধ্যা নামার আগেই পেরে আসবেন।